মাসুদ হাসান: বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নজরদারির অভাবে বর্তমানে বন্ধ এবং দুর্বল কোম্পানিগুলো দেশের স্টক এক্সচেঞ্জ দখল করে রেখেছে। আর জবাবদিহিতার অভাবে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের ঠকিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর। এভাবে দেশের পুঁজিবাজার আর কত দিন চলবে সেটি এখন বিনিয়োগকারীদের কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০২৩ সালে পুঁজিবাজারে মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষে ছিল নিলামে উঠা কোম্পানি এমারেল্ড অয়েল। ফেব্রয়ারি মাসে শেয়ারটির দাম ২৮ টাকা থাকলেও চলতি মাসে শেয়ারটির দাম উঠে যায় ১৮৯ টাকা। অর্থাৎ ৫ মাসের ব্যবধানে প্রায় ৭০০% দাম বৃদ্ধি পায় শেয়ারটির। এমারেল্ড অয়েল কোম্পানির সম্পদ ঋণাত্মক, ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক। কোম্পানির কাছে বেসিক ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, প্রাইম ফাইন্যান্স, মাইডাস ফাইন্যান্সের ঋণ বাবদ ১৭০ কোটি টাকা দাবি আছে। আগামী ১৬ আগস্ট নিলামে উঠছে এমারেল্ড ওয়েলের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি।
দাম বৃদ্ধির দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে খান ব্রাদার্স। ৩ মাসে শেয়ারটি ৪৫০% দাম বৃদ্ধি পায়। শেয়ারটি EPS নেগেটিভ। বিভিন্ন পত্রিকা মারফত জানা যায় কোম্পানি বর্তমানে উৎপাদনে নেই।
দাম বৃদ্ধির তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে লিগ্যাসি ফুটওয়্যার। ৩ মাসে ৩৫০% দাম বৃদ্ধি পায় শেয়ারটি। অত্যন্ত দুর্বল মৌলভিত্তির এই কোম্পানিটি ২০২০ এবং ২০২২ সালে কোন ডিভিডেন্ড দিতে পারেনি। মৃত প্রায় এই কোম্পানির EPS ঋণাত্মক।
এছাড়াও চলতি বছর দাম বৃদ্ধির শীর্ষে রয়েছে ইয়াকিন পলিমার, অলিম্পিক এক্সেসরিজ, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, ফাইন ফুডস, আলহাজ্ব টেক্সটাইল, ফুয়াং ফুড। সবগুলো কোম্পানি হয় মৃত, না হয় অর্ধমৃত।
বিএসইসির দুর্বল পর্যবেক্ষণ এবং জবাবদিহিতার অভাবকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে দেশের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারণা করছে।
তালিকাভুক্ত মীর আক্তার হোসেন লিমিটেড দেশের অন্যতম বৃহৎ ঠিকাদার কোম্পানি। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবার আগে কোম্পানির EPS ছিল ৬ টাকা। সেই কোম্পানি চলতি বছর প্রথম এবং তৃতীয় প্রান্তিকে EPS দিয়েছে মাত্র ২৭ পয়সা। অর্থাৎ মাসে তাদের আয় ১ কোটি টাকা। মীর আক্তারের ওয়েবসাইট খুললেই দেখতে পাবেন তাদের বাৎসরিক টার্নওভার ১.৮ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ প্রায় ২০০০ কোটি টাকা। বাৎসরিক টার্নওভার ২০০০ কোটি টাকা অথচ মাসে আয় ১ কোটি টাকা, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যথেষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি করে।
মীর আক্তার বর্তমানে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার সরকারী বিভিন্ন প্রোজেক্টের কাজ করছে। গত মার্চ মাসেও ৩৮০০ কোটি টাকার ঢাকা-সিলেট রোড নির্মাণের কাজ পায় কোম্পানিটি। নুতন নুতন কাজ পেলেও কোম্পানির আয় নেই বললেই চলে। গত বছর মীর আক্তার কোম্পানির বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীরা বিএসইসিতে লিখিত অভিযোগ জমা দিলেও বিএসইসির পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বিএসইসি শক্ত পদক্ষেপ নিলে আজ হয়তো শেয়ারটি তার ইস্যু মূল্যের নিচে থাকতো না।
এসিআই দেশের একটি প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি। এই কোম্পানির সাবসিডিয়ারি কোম্পানি আছে ১৫টি। এই কোম্পানির প্রোডাক্ট আছে ৫০০০ এর উপরে। অথচ কোম্পানির EPS ঋণাত্মক। একের পর এক ব্যবসা বৃদ্ধি করে যাচ্ছে অথচ কোম্পানি লাভ করতে পারছে না। গত সপ্তাহেও কোম্পানিটি এভিয়েশন এবং ডিজিটাল ব্যাংকের ব্যবসায় নামার ঘোষণা দিয়েছে। ১ বছর থেকে কোম্পানির কোন ক্রেতা নেই।
রানার আটো বাজারে তালিকাভুক্ত হয় ৬৭ টাকা করে। ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় করে ময়মনসিংহের ভালুকায় বাজাজ অটোর প্রযুক্তিগত সহযোগিতায় অটো রিকশা কারখানা তৈরি করে। কারখানাটি উৎপাদনে যায় চলতি বছর। অথচ কোম্পানির EPS নেগেটিভ। গত ১ বছর থেকে কোম্পানির কোন ক্রেতা নেই।
উপরের উল্লেখিত কোম্পানি গুলো ছাড়াও ওয়ালটন, জিপিএইচ ইস্পাত, বারাকা পতেঙ্গা, এনার্জিপ্যাক, ইফাদ অটো, এস্কয়ার নিট, ন্যাশনাল পলিমার, সিঙ্গার বিডি, বিবিএস ক্যাবল, পাওয়ার গ্রিড, শাহজিবাজার পাওয়ার, বিএসআরএম লিমিটেডের মতন বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় আশানুরূপ নয়।
আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, এলসি জটিলতায় অনেক প্রতিষ্ঠানের আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আবার কেউ কেউ আয় বেশি হলেও বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড দিতে কার্পণ্য করছে। কিন্তু উৎপাদন বন্ধ ও অস্তিত্ব সংকটে থাকা কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর এক শ্রেণীর বিনিয়োগকারী অতিমূল্যায়িত করে অন্যান্য বিনিয়োগকারী তথা পুঁজিবাজারের ক্ষতি করছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ ব্যাপারে অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পুঁজিবাজার তার আপন গতি ফিরে পাবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ডেইলি শেয়ারবাজার ডটকম/মু.