মাসুদ হাসান: বর্তমানে দেশের মুদ্রাস্ফীতি সর্বোচ্চ। দেশের প্রতিটি দ্রব্য মূল্যের দাম ২ বছরের মধ্যে ৫০% থেকে ১০০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। তেল, চিনি, পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, আদা, আলু, পোলাওয়ের চাল, মাছ, মাংস,ডিম, সবজি, ফল এমন কি গায়ে দেয়া সাবানের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৫০ শতাংশ। ২ বছর আগেও যে চিনির দাম ছিল ৫০ টাকা সেই চিনি এখন ১৪৫ টাকা। গরুর মাংসের দাম বর্তমানে ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা। আমার ধারনা পৃথিবীতে গরুর মাংসের সর্বোচ্চ দাম এখন বাংলাদেশে। দেশের প্রতিটি ভোগ্যপণ্যে মূল্য দেশের ইতিহাসে বর্তমানে সর্বোচ্চ দামে অবস্থান করছে।
দেশের মানুষ এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আগে পড়েনি
১০ বছর আগে ২০১৩ সালের জুন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে সেই রিজার্ভ কমতে কমতে ১০ বছর আগের রিজার্ভের কাছাকাছি চলে আসছে। যদিও ১০ বছর আগে আমাদের ডলারের যে চাহিদা ছিল তা বর্তমানে অনেক বেড়ে গেছে। গত ১ বছর থেকেই ডলার সংকটের কারনে সরকার পণ্য আমদানির উপর এক ধরনের রাশ টেনে রেখেছে। কিন্তু তারপরেও রিজার্ভের পতন থামানো যাচ্ছে না। ২০২১ সালে রিজার্ভ ছিল ৪০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার যা ২ বছর না যেতেই কমতে কমতে সেপ্টেম্বরে ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ।
রিজার্ভের পতন থামানোর জন্য খুব দরকার ছিল রেমিট্যান্স আয়। অথচ সেপ্টেম্বরে ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স আয় এসেছে। যা মরার উপর খাড়ার ঘা।
গত ২ বছরে টাকার মান কমেছে ৩০ শতাংশ। ২ বছর আগেও ১ ডলার ক্রয় করতে ৮০ থেকে ৮২ টাকা খরচ করতে হতো। সেখানে এখন ১ ডলার ক্রয় করতে ১১০ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। যদিও খোলা বাজারে ১১৫ টাকার নিচে ডলার পাওয়া যায় না। ডলার সংকট যদি এভাবে বাড়তে থাকে তাহলে টাকার মান আরও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে টাকার মান এভাবে কমে যেতে আগে কখনো দেখা যায়নি।
দেশের বর্তমান এই ডলার সংকটকে আরও ভাবিয়ে তুলেছে বৈদেশিক ঋণ। গত ১৪ বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ৩২২ শতাংশ বেড়েছে। ২০০৯ সালের জুন মাসে বৈদেশিক ঋণ ছিল ২৩.৫ বিলিয়ন ডলার। সেখানে ২০২৩ সালের জুনের শেষে বৈদেশিক ঋণ ৯৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বর্তমান এই বৈদেশিক ঋণ রিজার্ভ এবং ডলার সংকটকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারে বলে অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন।
ডলার এবং রিজার্ভ সংকটের পাশাপাশি দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলো বড় ধরনের সংকটের মধ্যে দিন পার করছে। দেশের নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলো একেবার লেজে গোবরে অবস্থা। এক পিকে হালদার একাই ৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ১)পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (পিএলএফএস), ২)ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস লিমিটেড, ৩)এফএএস ফাইন্যান্স এবং ৪)রিলায়েন্স ফাইন্যান্স। এছাড়াও দেশের ব্যাংকিং খাতেও চলছে চরম অস্থিরতা। বর্তমানে দেশের খেলাপি ঋণ নুতন রেকর্ড করেছে। দেশের ব্যাংকিংখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এ বছরের জুন পর্যন্ত ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। দেশের ইতিহাসে এটিই সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের রেকর্ড।
দেশের অর্থনীতির দর্পণ বা আয়না বলা হয়ে থাকে দেশের পুঁজিবাজারকে। অথচ আমাদের দেশের পুঁজিবাজার অন্ধকারে নিমজ্জিত। পুঁজিবাজারে কান পাতলেই শুনতে পাবেন বিনিয়োগকারীদের হাহাকার। ১৫ মাস হতে চললো পুঁজিবাজারের দুই-তৃতীয়াংশ কোম্পানি ক্রেতা শুন্য। বিনিয়োগকারীরা চাইলেও হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করতে পারছে না।
২০০৯ সালে ভারতের সেনসেক্সের ইনডেক্স ছিল ৮৮৯১। গত ১৫ বছরে ভারতের ইনডেক্স চলে গেছে ৬৬১৫১ অর্থাৎ ১৫ বছরে ভারতের পুঁজিবাজারের গ্রোথ হয়েছে ৭০০ শতাংশ। ২০১০ সালে বাংলাদেশের ইনডেক্স ছিল ৯০০০ সেখানে ২০২৩ সালে পুঁজিবাজার এসে দাড়িয়ে আছে ৬৩০০ ইনডেক্সে। অর্থাৎ গত ১৪ বছরে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের গ্রোথ ঋণাত্মক। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ২০০৯ সালে গড়া ১৪ বছর আগের সেই রেকর্ড ভাঙ্গা তো দূর সেই ইনডেক্সের কাছেও যেতে পারেনি।
বর্তমানে দেশের প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি বিনিয়োগকারী এক ধরনের অস্বস্তির মধ্যে দিন পার করছে। এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতে দেশের মানুষকে আগে পড়তে হয়নি।
ডেইলি শেয়ারবাজার ডট কম/মু.