গত বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি করেন অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য কাওছার আহমেদ। পেনশনের টাকা ও ঋণ নিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে তিনি এখন নিঃস্ব। চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা। বর্তমান পুঁজিবাজারে এই রকম কাওছার আহমেদের সংখ্যা অনেক। বেশীরভাগ বিনিয়োগকারী তাদের কষ্টের কথা গুলো সামাজিক লজ্জার কারনে প্রকাশ করতে পারছে না। গত বছর বিএসইসি’র চেয়ারম্যান বলেছিলেন “পুঁজিবাজারে নির্ভয়ে আসুন, আমরা আপনাদের পুঁজির নিরাপত্তা দিবো”। কথা গুলো এখন যেন হাস্য রসে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ শিক্ষা মূল্যহীন। তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। রাতারাতি কোম্পানিগুলোর আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যায়। তারপরও ৫ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে আপনি যদি একটি ভালো কোম্পানির শেয়ার কিনলেও বছরের পর বছর বসে থাকতে হয়। শেয়ারের দাম বাড়বে না।
যদি বিনিয়োগকারীরা ডিভিডেন্ড নেয় তাতেও খুব একটা লাভ হবে না। বছর শেষে দেখা যাবে সঞ্চয়পত্রের সুদ থেকেও আয় কম হয়েছে। তাহলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ না করে কেন ঝুঁকি নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা হবে। এ ধরনের পরিস্থিতির কারণে গবেষণা ভিত্তিক বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয় বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে।
বেশির ভাগ সময় ছোট কোম্পানি, লোকসানী কোম্পানি এবং বন্ধ কারখানার শেয়ারগুলো বাজারে প্রচুর লেনদেন হয় এবং শীর্ষ দরবৃদ্ধির তালিকায়ও উঠে আসে। এমনকি শীর্ষ লেনদেনের তালিকাতেও এদের সব থেকে বেশি প্রাধান্য থাকে। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, শাইন পুকুর সিরামিক গত ২ মাস লেনদেনের শীর্ষে অবস্থান করছে অথচ কোম্পানিটি বিগত ৯ বছরের মধ্যে ৭ বছর বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড দিতে পারেনি আর ৫ বছর EPS ছিল নেগেটিভ।
গত ৪ মাসে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের মূল্য বৃদ্ধির শীর্ষে ছিল ইমাম বাটন কোম্পানিটি। চার মাস আগেও এই কোম্পানির শেয়ারের দাম ছিল ২০ টাকা আর এখন ১৩১ টাকা। অর্থাৎ ৪ মাসে শেয়ারটির দাম ৬০০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। শুনলে অবাক হতে হয়, এই ইমাম বাটন কোম্পানির কারখানা বন্ধ। ১১ বছর থেকে বিনিয়োগকারীদের কোন ডিভিডেন্ড দেয়না।
এই ভাবে দুর্বল কোম্পানিগুলো যদি লেনদেন এবং দর বৃদ্ধির শীর্ষে থাকে তাহলে বিদেশী বিনিয়োগকারী তো অনেক দূর, দেশের বিনিয়োগকারীরাও বাজার থেকে দূরে সরে যাবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টের লক্ষ্যে ‘রোড শো’ গুলো সার্থকতা হারাবে। যদিও ‘রোড শো’ গুলো বিনিয়োগকারীদের কাছে এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
ভালো কোম্পানির শেয়ার কিনে বছরের পর বছর বসে থেকে লাভ করতে না পেরে অনেক বিনিয়োগকারী নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন এবং লাভের আশায় দুর্বল, লোকসানি বা কারখানা বন্ধ এমন কোম্পানির শেয়ারগুলো কিনে ফেলেন। এতে অল্প কিছু সংখ্যক ব্যাক্তি লাভ করলেও বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীরাই টাকা হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন।
অনেকেই শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীদের লোভী বলা হয়। আর লোভ আছে বলেই তো সে সঞ্চয়পত্র না কিনে পুঁজিবাজারে আসা হয়। বিনিয়োগকারীদের দোষ দিতে গিয়ে মূলত কারসাজির সাথে জড়িত ব্যাক্তিদের আড়াল করে ফেলা হচ্ছে।
এই বাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য পরিকল্পিত ভাবে ফাঁদ তৈরি করা হয়, আর সেই ফাঁদে পড়ে বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়। এটাই যেন বাংলাদেশের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেষ পরিণতি। পুঁজিবাজারের যে সকল স্টেকহোল্ডার আছে তাদের সবার উদ্দেশ্য একটাই আর তা হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন ভাবে ধোকা বা প্রলুব্ধ করে তাদের টাকাগুলো নিজেদের পুঞ্জিভূত করা।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে এত বেশি দুর্নীতি হয় যে এখানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে ভয় পায়। বিএসইসির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে লেনদেনে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ মাত্র ২০ শতাংশ। যেখানে ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে টার্নওভারের ৫৫ শতাংশ করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা।
১৫ থেকে ২০ বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া কোম্পানিগুলো OTC মার্কেট থেকে যে ভাবে নুতন মোড়কে বাজারে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে তা রীতিমত ভয়ঙ্কর। বন্ধ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে কিছু মানুষ ১৫-২০ আগে নিঃস্ব হয়েছিল। এখন ঐ কোম্পানিগুলো বাজারে ফিরিয়ে এনে আবার নতুন করে কিছু মানুষকে নিঃস্ব করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
যেভাবে মিষ্টি কথা বলে যে সকল যুক্তি দাঁড় করিয়ে OTC তে থাকা কোম্পানি গুলোকে হালাল করার চেষ্টা করা হচ্ছে তাতে অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য কাওছার আহমেদের মতন আরও অনেক বিনিয়োগকারীদের হাউমাউ করে কাঁদতে হবে। এটা বিনিয়োগকারীদের লোভের প্রায়শ্চিত্ত নয়, এটা পরিকল্পিত ফাঁদ, একটি অপরাধ।
লেখক: তানভীর আহমেদ,বিনিয়োগকারী।
ডেইলি শেয়ারবাজার ডটকম/নি.