২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ধস নামার নেপথ্যে অন্যতম মূল কারণ ছিল ব্যাংকের বিনিয়োগ। কারণ পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ হিসাব ওই সময় বাজার মূল্যের ওপরে বিবেচনা করা হতো যা এখনো চলমান। শেয়ার দর বৃদ্ধি পেলে মার্কেট প্রাইসের ওপর ভিত্তি করে গণনা করার কারণে বিনিয়োগ সীমা অতিক্রম হয়ে যায়। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী শেয়ার বিক্রি করে আবার বিনিয়োগ সীমার নিচে নামিয়ে আনতে হয়। এক্ষেত্রে অনেকগুলো ব্যাংক একসঙ্গে শেয়ার বিক্রি করলে পুঁজিবাজারে অতিরিক্ত সেল প্রেসারে তৈরি হয়। আর এভাবেই এক সময় পুঁজিবাজারে ধস নেমে আসে যা ২০১০ সালে ঘটেছিল।
যেহেতু বর্তমান পুঁজিবাজারও ২০১০ সালের মতো ফুলে ফেঁপে উঠছে, শেয়ার দর ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই ব্যাংকগুলোরও বিনিয়োগসীমা অতিক্রম করে ফেলবে। তখন নিয়ম মানতে ব্যাংকগুলো শেয়ার বিক্রি শুরু করবে যা আরেকটি ধস নামার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সৃষ্ট এ জটিল বিষয়টি সমাধান করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনতিবিলম্বে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার।
একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তার মোট মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করতে পারবে না। আর শেয়ারের ধারণকৃত মূল্য নির্ধারণ করা হয় বাজার মূল্যের ভিত্তিতে। ব্যাংকগুলোর ধারণকৃত শেয়ারের মূল্য বাজারে বেড়ে গেলে আইনের বাধ্যবাধকতা অমান্য হয়ে যায়। আর রাতারাতি শেয়ার বিক্রি করে নির্ধারিত সীমার মধ্যে নামিয়ে আনা যায় না। আবার নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করলেই ব্যাংকগুলোকে জরিমানা গুনতে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। এভাবে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের শেয়ার ধারণের সর্বশেষ সীমা নিয়ে উভয় সঙ্কটে পড়েছে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকির শিথিলতায় ২০০৯ সালে কৃষি ও এসএমই ঋণের বড় একটি অংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছিল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বিনিয়োগ ঝুঁকিমুক্ত রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ২০১০ সালে কঠোর তদারকির মধ্যে নিয়ে আসে ব্যাংকগুলোকে। ফলে পুঁজিবাজারে বড় ধরনের ধস নামে। আগে ব্যাংকগুলো তার মোট দায়ের ১০ শতাংশ সমপরিমাণ অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বা শেয়ার ধারণ করতে পারতো। মোট দায় বলতে, ব্যাংকগুলোর মূলধন বাদে সব সম্পদের মূল্যের যোগফল বোঝাতো। ওই সময় ব্যাংকগুলোতে ৫ লাখ কোটি টাকার মোট সম্পদ ছিল।
সে হিসাবে ২০১০ সালের আগে ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে শেয়ার ধারণ করেছিল। কিন্তু ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ভয়াবহ দরপতনের পর থেকে ব্যাংকগুলোর মূলধন কমতে থাকে। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর জন্য পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে করাকড়ি আরোপ করে। এরই ফাঁকে ২০১৩ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়। সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ব্যাংকগুলো তার মোট মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করতে পারবে না। এখন মোট মূলধন বলতে বোঝায় ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন, সংবিধিবদ্ধ সঞ্চিতি, রিটেইন আর্নিং ও শেয়ার প্রিমিয়াম অ্যাকাউন্টের সমন্বয়ে যে অর্থ থাকবে তাই। এ আইন সংশোধনের আগে তখন ব্যাংকিং খাতে মোট সম্পদ ছিল ৫ লাখ কোটি টাকা। এর ১০ শতাংশ হিসেবে ৫০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ছিল পুঁজিবাজারে। কিন্তু যখন আইন সংশোধন করা হয় তখন মোট মূলধন নেমে আসে ৫০ হাজার কোটি টাকার। এর ২৫ শতাংশ হিসাবে ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার কথা সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার। আইন সংশোধনের আগে, বেশির ভাগ ব্যাংকেরই বাড়তি বিনিয়োগ ছিল। এ কারণে বাড়তি বিনিয়োগ সমন্বয়ের জন্য ২০১৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়া হয়।
ওই সময় থেকেই ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ নিয়ে নানা সমস্যায় ভুগে আসছে। সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েছে বিনিয়োগের সর্বশেষ সীমা নিয়ে। কারণ, ব্যাংকগুলোর যে পরিমাণ শেয়ার ধারণ করে তা নির্ধারণ হয় শেয়ারের বাজার মূল্যের ভিত্তিতে। যেমন, একটি ব্যাংক তার মোট মূলধন রয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। এর ২৫ শতাংশ হিসাবে ১২৫ কোটি টাকার শেয়ার ধারণ করতে পারবে। ওই ব্যাংকটি এ হিসাবে ১২৫ কোটি টাকার শেয়ার কিনলো। কিন্তু একদিন পর ধারণকৃত শেয়ারের মূল্য বেড়ে ১৫০ কোটি টাকা হলো। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নির্ধারিত সীমার চেয়ে শেয়ারের মূল্য ২৫ কোটি বেড়ে গেলো। এখন ব্যাংককে আইনের বাধ্যবাধকতার কারণে দিনের মধ্যেই ২৫ কোটি টাকার বাড়তি শেয়ার বিক্রি করতে হবে। কিন্তু একটি ব্যাংক ইচ্ছে করলেই ওই দিনে শেয়ার বিক্রি করতে পারবে না। এ জন্য পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নীতিমালা মেনেই শেয়ার বিক্রি করতে হবে।
এ কারণে ওই দিনে শেয়ার বিক্রি করতে না পারলে ব্যাংক কোম্পানি আইনের লঙ্ঘন হবে। আর এ জন্য জরিমানা গুনতে হবে আরেক নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে।
ডেইলি শেয়ারবাজার ডটকম/মাজ./নি