ডেইলি শেয়ারবাজার ডেস্ক: সংবিধানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, উপরাষ্ট্রপতি ও উপপ্রধানমন্ত্রী পদ সৃজনসহ ৬২টি সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে বহুল আলোচিত ৭০ অনুচ্ছেদে বড় পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে জমা দেওয়া প্রস্তাবনায় পরপর দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার বিধান যুক্ত করার কথাও বলা হয়েছে। সংসদ ভবনে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনের অস্থায়ী কার্যালয়ে এ প্রস্তাবনা জমা দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
এ সময় তিনি জানান, ক্ষমতায় ভারসাম্য আনতেই এসব প্রস্তাব করা হয়েছে। বিচার বিভাগের ক্ষেত্রেও তারা পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছেন। তবে আগামী নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য।
সংবিধান সংস্কার কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পরই দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কার প্রস্তাব পেশ করতে বলেছিল। সেই আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি তাদের প্রস্তাব লিখিত আকারে জমা দেয়। বিএনপির প্রস্তাব জমা দেওয়ার পর সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে জমা দেওয়া প্রস্তাব তারা এখনও খুলে দেখেননি। সংবিধান সংস্কারের ওয়েবসাইটে ৫০ হাজারেরও বেশি মতামত এসেছে। আরও কয়েকটি সংগঠন ও নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে তারা কথা বলবেন।
আলী রীয়াজ জানান, সংবিধানের বিষয়ে বিবিএসের মাধ্যমে আগামী সপ্তাহ থেকে সারাদেশে জরিপ শুরু হবে। যাতে সব ধরনের মানুষের মত তারা জানতে পারেন। নগর, গ্রামের বয়স্ক-তরুণদের মতামত নেওয়া হবে। রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
সংস্কার কমিশন এবং বিএনপিসহ কোনো পক্ষই জমা দেওয়া প্রস্তাবে কী আছে, তা প্রকাশ করেনি। তবে বিএনপি সূত্র জানিয়েছে, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে যে মৌলিক পরিবর্তন এনে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সন্নিবেশ করা হয়েছে তা পরিবর্তন করে আগের অবস্থায় ফেরত যাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
সংবিধানের ঘোষণাপত্র, প্রস্তাবনাসহ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অপরিবর্তনীয় রাখার যে বিধান করা হয় তা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ যুক্ত করতে বলা হয়েছে। এছাড়া নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, উপরাষ্ট্রপতি ও উপপ্রধানমন্ত্রী পদ সৃজন, একই ব্যক্তি পরপর দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না– এমন প্রস্তাব করা হয়েছে।
২০১১ সালের ৩০ জুন নবম সংসদে পাস হওয়া পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা’ বিলুপ্ত করা হয়েছিল। সংসদ সচিবালয় সূত্র জানিয়েছে, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ৬১টি সংশোধনী পাস করেছিল। এরমধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন ছিল আটটি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে– ঘোষণাপত্র ও প্রস্তাবনা, মূলনীতি, সংবিধান স্থগিতের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, মৌলিক কাঠামো, গণভোট, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, জাতির পিতা ও একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা। বিএনপির প্রস্তাবে মূলত এগুলো বাদ দিয়ে সংবিধানকে আগের জায়গায় নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীতে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং যা বাদ দেওয়া হয়েছে সবই আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, সংবিধান ৭০ অনুচ্ছেদে বড় পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। আস্থাভোট, অর্থবিল, বাজেট, প্রতিরক্ষাসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছাড়া অন্য বিষয়ে সংসদে এমপিদের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে।
এসব প্রস্তাব নির্বাচিত সরকার বাস্তবায়ন করলে বর্তমান সংস্কার কমিশনের কাছে কেন বিএনপি প্রস্তাব দিচ্ছে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংসদ ছাড়া সংবিধান সংশোধনীর ভিন্ন কোনো উপায় আছে বলে তারা মনে করেন না। তবে কমিশনের কাছে এ প্রস্তাব দেওয়ার অর্থ তারা সবার সঙ্গে আলোচনা করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুপারিশ করবেন। তার ভিত্তিতে সরকার রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে ঐকমত্য তৈরি করবে। তিনি বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সবাই একমত হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দ্বিমত থাকতেই পারে। ঐকমত্য হওয়ার বিষয়ে সবাই অঙ্গীকার করলে এবং নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিফলন থাকবে।
এর আগে সংসদ ভবনে সংস্কার কমিশনের কাছে বিএনপির প্রস্তাবনা জমা দেওয়ার কথা তুলে ধরে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, সূচনা থেকে শুরু করে তপশিল পর্যন্ত ৬২টি জায়গায় বিভিন্ন প্রস্তাব, সংশোধনীর প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রস্তাবনার মূল অংশে দেশের রাজনীতির চরিত্র পরিবর্তনের বিধান পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ করেছিল। সেগুলোসহ কিছু নতুন প্রস্তাব বিএনপি দিয়েছে। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রস্তাবে দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের শহীদের রক্তের অঙ্গীকার ও বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনা করে ভবিষ্যতে যাতে সংসদীয় একনায়কতন্ত্র সৃষ্টি না হয়, সেগুলো মাথায় রেখে প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য আনার প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, পরপর দুইবারের বেশি কেউ যেন প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন না হন সে বিধান রাখা হয়েছে। নতুন করে সংসদের উচ্চকক্ষ সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়েছে। বিচার বিভাগের বিষয়ে বিএনপি নতুন প্রস্তাব দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ যাতে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে থাকে এবং যথোপযুক্তভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় সেটি বলা হয়েছে। প্রস্তাবনায় প্রজাতন্ত্র, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, তপশিলসহ সব বিষয়ে সন্নিবেশ করা হয়েছে। রাষ্ট্রের সব অঙ্গে যাতে সবক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি হয়, সেই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
সংবিধান পুনর্লিখনের বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বিএনপির অবস্থান জানতে চাইলে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাপক ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়। বিএনপির প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন রানা।
সংবিধান সংস্কার যাত্রা শুরু হয় ৬ অক্টোবর। সে হিসেবে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় রয়েছে কমিশনের হাতে। নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে নির্বাচন সংস্কার-সংক্রান্ত সব বিষয়ে কমিশনের সুপারিশ করার কথা। কমিশন ইতোমধ্যে ২৮টি সংগঠন, সুশীল সমাজের ২৩ জন প্রতিনিধি, ৫ জন সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং ১০ জন তরুণ চিন্তাবিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। সংবিধান সংস্কার বিষয়ে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জনগণের মতামত গ্রহণ করা হচ্ছে। সোমবার বিকেল পর্যন্ত মোট সাত লাখ ৪০ হাজার ৯৭ জন মতামত দিয়েছেন।
এছাড়াও বিবিএসের মাধ্যমে সারাদেশে জনমত জরিপ কার্যক্রম দ্রুতই শুরু হচ্ছে। কমিশনপ্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সংবিধান শুধু একটি নির্বাচনের বিষয় নয়। সংবিধানে নির্বাচনের বিষয়ে যেসব মতামত এসেছে সেগুলোর ভিত্তিতে সুপারিশ তৈরি করা হবে।
ডেইলি শেয়ারবাজার ডটকম/এম আর.